‘সোহরাওয়ার্দীর এক বিকেল’ – ওয়াহিদুল আলম সোহেল
মাথার উপর ঝকঝকে নীল অাকাশ। পৌষের হিমেল হাওয়া বইছে। পশ্চিমে ডুবে যাবার অন্তিমকালে নরম রোদের অালতো পরশ পৃথিবীকে দিয়ে যাচ্ছে রক্তিম সূর্য। পাখিদের শরীরেও লেগেছে সে রোদ। মাঝেমাঝে অাকাশের মাঝখানটায় তাদের দেখা মিলছে শব্দহীন ডানা ঝাপটানোর দৃশ্যের ভেতর। অামি বসে অাছি মাঠের মধ্যখানে।
অামার চতুর্দিকে সহস্র মানুষ। অামি, অামরা এসেছি অাজ তাঁদের অমিয় বাণী শুনতে। যেমন শুনেছিলাম অালমে অারওয়ায়। যেমন অামাদের পূর্বসূরীগণ শুনেছিলেন অারাফাতে। অামরা অাজ এসেছি সোহরাওয়ার্দীতে। অামাদের সকলের হাত অাজ মুষ্টিবদ্ধ। অামাদের ঠোঁটে রেসালাতের দৃপ্ত শ্লোগান। অামাদের বুকে ক্ষীপ্ত সাহস। অামাদের চোখ অাজ শীতল। অামরা তাতে মেখেছি প্রেমের মায়া। সেই প্রেম ভরাতুর চোখে অামরা সামনে তাকাই। অামাদের সম্মুখে, অদূরে, বিশাল পবিত্র মঞ্চে চেহেরায় শুভ্রতা মেখে বসে অাছেন তাঁরা।
একটু পরেই অামরা শুনবো তাঁদের পবিত্র বাণী। অামাদের তাড়া নেই, অস্থিরতা নেই। অামরা বসে অাছি অাজ সাঁইত্রিশ বছর। এবার অামাদের অপেক্ষার পালা ফুরাবার পথে।
অামরা যখন মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠাতে যাবো, যখন অামাদের ঠোঁটে ফুটে উঠতে যাবে গোলাপের শব্দ, ঠিক তখন অামরা দেখি, পবিত্র মঞ্চে বসা, সকলের মাঝখানে বসা, কপালে তাঁর অালোর ঝিলিক, শ্বেতশুভ্র দাড়ি সারা মুখে, দু’চোখ তাঁর বন্ধ, তিনি হঠাৎ উপরে উঁচিয়ে ধরলেন তাঁর ডান হাতের তর্জনী। অামি, অামরা, সহস্র সন্তান, কিছু বুঝে উঠতে পারি না। সবিস্ময়ে দেখে উঠি, পবিত্র মঞ্চে বসা সকলেই উঁচিয়ে ধরলেন তাঁদের ডান হাতের তর্জনী। সকলের মাথায় সবুজ কাপড়। অামি, অামরা, সহস্র সন্তান, কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ি। দাঁড়িয়ে যান তাঁরাও।
অামাদের কি হল কে জানে! অামরা হঠাৎ তখন অামাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত মেলে বুকে রাখি। অামাদের বুকে তখন প্রেম, অামাদের চোখে তখন প্রেম। অাল্লাহর কসম, প্রেম ভরাতুর চোখে অামরা সম্মুখে, পবিত্র মঞ্চে তখন দেখে উঠি পবিত্র মানুষদের! অামরা দেখি অাকা অালা হযরতকে!
অামাদের চোখে তখন বিস্ময়! অার প্রেম! প্রেম ভরাতুর চোখে অামরা দেখি শাহ জালাল ইয়েমেনিকে! তাঁর পাশে, সাদা শুভ্র পবিত্র পোশাকে, দেখি শাহ অামানতকে! তাঁর পাশে, অগ্নি-পুরুষ, দেখি গাজী শেরে বাংলাকে! তাঁর পাশে, নূরের প্রদীপ যেন প্রজ্জ্বলিত তার মুখে, দেখি তৈয়ব কা মকাম বহুত উঁচা হ্যায়! তিনি, তাঁরা, তাঁরা সকলে, অামরা, তাকিয়ে অাছি অারো একজনের দিকে! নূরের চমকানি তাঁর পবিত্র চেহেরায়, নাম তাঁর গোলামুর রহমান!
অামাদের ঠোঁটে রেসালাতের পবিত্র শ্লোগান। প্রকম্পিত চতুর্পাশ। পবিত্র মানুষেরা বসে পড়েন তখন। অামরাও। ঠিক তখন না বসে, বসবেন যেন একটু পর, বীরদর্পে দন্ডায়মান, পবিত্র মঞ্চে, অামরা চিনি তাঁকে, এখনো পাকেনি তাঁর দাড়িগুচ্ছ, বীর বাহাদুর মুজাদ্দেদী! অামাদের চোখ তখন খুঁজে ফিরে। অামরা সহসা দেখে উঠি, তাঁর পাশেই, শরীরে তাঁর সাদা পোষাক, গলায় সাদা কাপড়, চামড়ায় তাঁর মেশানো বেলালের পবিত্র রঙ! বাংলার রণবীর জয়নুল অাবেদিন জুবাইর!
সোহরাওয়ার্দীর চারদিকে সুনসান নিরবতা। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। পিনপতনের শীতল শব্দ যখন অামাদের কানে বাজতে লাগল ঠিক সে সময় টগবগে দুই তরুণ, লিয়াকত ও হালিম, অান্দোলনের বীর মুজাহিদ, উঠে দাঁড়ালো সহস্র সন্তানের মধ্য থেকে। তাঁদের সাথে, অামার, অামাদের, সহস্র সন্তানের ঠোঁটে ফুটে উঠল খোদার পবিত্র বাণী:
“সত্যের অাবির্ভাবে মিথ্যা তিরোহিত।”
ক্ষণকাল পরেই অামরা শুনবো পবিত্র মানুষদের অমিয় বাণী। অামরা, সহস্র-লক্ষ সেনানী অপেক্ষা করে অাছি সাঁইত্রিশ বছর। বিজয় দেখবার জন্যে অামরা অপেক্ষা করতে পারি অারো সহস্র বছর।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী ছাত্রসেনার ঐতিহাসিক সমাবেশকে স্মরণ করে নিউরনে অনুরণন তোলা এই লেখাটি লিখেছেন Wahidul Alam Sohel ।
২০২০ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে ছাত্রসেনার চার দশক পূর্তি উৎসব।